অভিজিৎ হাজরা, আমতা, হাওড়া :-গ্ৰামীণ হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া উত্তর বিধান সভা কেন্দ্রের অন্তর্গত আমতা ১ নং ব্লকের সিরাজবাটি চক্রের অধীন মোল্লারচক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় বিদ্যালয়ে এক সচেতনতা শিবির অনুষ্ঠিত হল।
বাগবাজার রামকৃষ্ণ মঠ এর মা সারদা চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি এবং প্যাথলজি সেন্টারের সহযোগিতায় বিনামূল্যে থ্যালাসিমিয়া ও হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা শিবির অনুষ্ঠিত হল।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উদ্যোগে এহেন সচেতনতা মূলক শিবিরে উপস্থিত ছিলেন আমতা ১ নং ব্লকের সিরাজবাটি চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক দীপঙ্কর কোলে,শিক্ষারত্ন পুরষ্কার প্রাপ্ত শিক্ষক অরুণ কুমার পাত্র, কুমারচক হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবাশীষ মন্ডল, শিক্ষক পবিত্র কুমার লাঙ্গল, মোল্লারচক গ্ৰাম পঞ্চায়েত সদস্যা কবিতা মাখাল,প্রাক্তন শিক্ষক নিরাপদ পন্ডিত, শিক্ষক বিশ্বনাথ মন্ডল, খড়দহ প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাকেশ পাত্র।
বিনামূল্যে থ্যালাসিমিয়া ও হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা শিবিরে মোল্লারচক প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ পার্শ্ববর্তী কুমারচক প্রাথমিক বিদ্যালয়,জজ্ঞালিচক শিশু শিক্ষা কেন্দ্র,মধ্যকুল স্কুল,শিবেরহানা হাই স্কুল, কুমারচক হাই স্কুল এর ৬০০ জন ছাত্র – ছাত্রী,যারা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে এমন কয়েকজন সহ এলাকার বেশ কিছু গর্ভবতী মায়েদের বিনামূল্যে থ্যালাসিমিয়া ও হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করা হয়। সেই সঙ্গে শিবিরে পরীক্ষা করা ছাত্র – ছাত্রী ও গর্ভবতী মায়েদের যথাক্রমে শীতকালীন জ্যাকেট ও কম্বল দেওয়া হয়।
মহতী এই সচেতনতা মূলক শিবিরে উপস্থিত থেকে আমতা ১ নং ব্লকের সিরাজবাটি চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক দীপঙ্কর কোলে বলেন, এই বিদ্যালয় সমাজকে, জেলাকে, রাজ্যকে ও দেশকে থ্যালাসিমিয়া মুক্ত করার জন্য যে বার্তা দিলেন তা প্রশংসার দাবি রাখে নিঃসন্দেহে। এই ধরনের সচেতনতা মূলক কর্মসূচি আমতা সিরাজবাটি চক্রের অধীনে ৭৭ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয় ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্র সহ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এর আগে হয়নি। এই বিদ্যালয় এহেন সচেতনতা মূলক কর্মসূচি গ্ৰহণে অন্য বিদ্যালয়গুলির পথপ্রদর্শক। আগামী দিনে এই মোল্লারচক প্রাথমিক বিদ্যালয় সুস্থ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে বিভিন্ন সচেতনতা মূলক শিবির, কর্মসূচি গ্ৰহণ করে সুস্থ সমাজ ও সুস্থ জেলা গঠনে অগ্ৰণী ভূমিকা নেবে বলে আশা করি।
বিদ্যালয়ের সহ শিক্ষক সুপ্রিয় প্রামাণিক বলেন, এই পরীক্ষা শিবির করার উদ্দেশ্য, এলাকার মানুষের মধ্যে সচেতনতা মূলক প্রচার,স্বাস্থ্য শিবির করা।জম্মের পর থ্যালাসিমিয়া রোগ প্রতিরোধ করার জন্য সাধারণ সচেতনতা যদি মানুষের মধ্যে থাকে তাহলে আমরা এটাকে আটকাতে পারি। শুধুমাত্র জীবনে একবার রক্তের পরীক্ষা করে সচেতন হয়ে এটাকে রোধ করা সম্ভব। আমাদের মূল উদ্দেশ্য, আমাদের সমাজ, আমাদের রাজ্য, আমাদের দেশকে থ্যালাসিমিয়া মুক্ত করা।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেবাশীষ হাজরা বলেন, এর আগে এই এলাকার অনেকেরই থ্যালাসিমিয়া পরীক্ষা হয় নি। তাই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্কুল শুধুমাত্রই শিক্ষার অঙ্গ নয়। আমরা শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিকভাবে সমাজের পাশে থাকি। সেটাই আমরা সারা বছর জুড়ে করে থাকি এবং ভবিষ্যতেও নানা সমাজসেবা মূলক কাজ এই বিদ্যালয়ের মাধ্যমে করতে চাই, অবশ্যই ছাত্র -ছাত্রী, অভিভাবক – অভিভাবিকা ও গ্ৰামবাসীদের সাথে নিয়ে। তিনি এও বলেন, এই বিদ্যালয় লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত রয়েছে।এর বাইরে রক্তদান শিবির ও করা হয়েছে। আমরা ছাত্র -ছাত্রীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুদের মানবিক মূল্যবোধ গঠনের শিক্ষা, সমাজসেবামূলক কাজের মানকিতা তৈরি,অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার শিক্ষা দিই। নানান খেলাধুলা শিখানো,সুস্থ সংস্কৃতি গড়তে নাচ, গান, আবৃত্তি, অঙ্কন, নাটক শিখানো হয়। ইতিমধ্যেই এই বিদ্যালয়ের ছাত্র -ছাত্রীরা জেলায় খেলাধুলায় ও সংস্কৃতিতে প্রশংসিত হয়েছে। তিনি আরো ও বলেন, এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সুপ্রিয় কুমার প্রামাণিক,ইন্দ্রনাথ খাঁ,পাশ্বশিক্ষকা মণিকা পন্ডিত, অতিথি শিক্ষিকা সঙ্গীতা মন্ডল,বনশ্রী পাত্রদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজকের এই সমাজসেবা মূলক মানবিক অনুষ্ঠানটি সফল হয়েছে।যার কথা না বললে হয় না তিনি মোল্লারচক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক বিদ্যুৎ মজুমদার।যার জন্য আজকের এই অনুষ্ঠান করতে পেরেছি।
সমগ্ৰ অনুষ্ঠান টি সঞ্চালনে করে শিবিরে আসা বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্র -ছাত্রী, গর্ভবতী মায়েদের ও অভিভাবক – অভিভাবিকা ও গ্ৰামবাসীদের উদ্যেশে থ্যালাসিমিয়া মুক্ত সমাজ গঠনের আহ্বান জানিয়ে শিক্ষারত্ন পুরষ্কার প্রাপ্ত শিক্ষক অরুণ কুমার পাত্র বলেন, থ্যালাসিমিয়া একটি বংশগত রোগ।এতে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্তের লোহিত কণিকা তৈরি হয় না। ফলে এদের মারাত্নক রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।থ্যালাসিমিয়া রোগীরা প্রতি মাসে ১ – ২ ব্যাগ রক্ত গ্ৰহণ করে বেঁচে থাকে। চিকিৎসা না করা হলে এই রোগী রক্তশূন্যতার কারণে মারা যায়।মানব কোষে রক্ত তৈরি করার জন্য ২ টি জিন থাকে। কোন ব্যক্তির রক্ত তৈরীর ১ টি জিনে ত্রুটি থাকলে তিনি থ্যালাসিমিয়া বাহক।আর যদি ২ টি জিনেই ত্রুটি থাকে তাহলে তিনি থ্যালাসিমিয়া রোগী।থ্যালাসিমিয়া বাহকরা সম্পুর্ণ সুস্থ এবং এদের কোন বাহ্যিক লক্ষন থাকে না। তাই এদের চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।
একজন থ্যালাসিমিয়া বাহক যদি অপর একজন বাহককে বিবাহ করেন তাহলে তাদের প্রতিটি সন্তানের থ্যালাসিমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা পঁচিশ শতাংশ।এ ধরণের পরিবারে একাধিক সন্তান থ্যালাসিমিয়া আক্রান্ত হওয়ার নজির রয়েছে। জেনে রাখা ভালো যে,রক্তের গ্ৰুপের সাথে থ্যালাসিমিয়া রোগ হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। শিশু জম্মের ১ থেকে ২ বছরের মধ্যে থ্যালাসিমিয়া রোগ ধরা পড়ে। এই রোগের লক্ষণ গুলো হল,ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, দুর্বলতা,ঘন ঘন ইনফেকশন, শিশুর ওজন বৃদ্ধি না হওয়া,জন্ডিস, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি।থ্যালাসিমিয়া রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়বহুল। রক্তশূন্যতা পূরণের জন্য রোগীদের প্রতি মাসে ১ থেকে ২ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। এছাড়াও এদের শরীর থেকে ক্ষতিকর লৌহ বের করার জন্য নানাবিধ দামী ঔষধ খেতে হয়। একটি শিশুর চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।থ্যালাসিমিয়া রোগের কোন সহজলভ্য স্থায়ী চিকিৎসা বা টীকা নেই। এই রোগ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে এটি প্রতিরোধ করা।স্বামী – স্ত্রী দুজনই যদি থ্যালাসিমিয়া বাহক হন, শুধুমাত্র তখনই সন্তানদের এই রোগ হতে পারে। কিন্তু স্বামী – স্ত্রী দুজনের একজন যদি বাহক হন এবং অন্যজন সুস্থ হন, তাহলে কখনোই এই রোগ হবে না। তাই বিয়ের আগে থ্যালাসিমিয়া বাহক কিনা সবারই তা জানা উচিত। হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস নামে একটি রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে কোন ব্যক্তি থ্যালাসিমিয়া বাহক কিনা নির্ণয় করা যায়। এই পরীক্ষা যে কোন ভালো ডায়াগনোস্টিক ল্যাবরেটরিতে করা যায়।
এই পরীক্ষা শিবিরকে কেন্দ্র করে মোল্লারচক প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উৎসবের আমেজে জনতার ঢল নামে। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্র -ছাত্রী, গর্ভবতী মায়েদের এই পরীক্ষা শিবিরে আসার লাইন ঠিক করতে মাঝে মধ্যেই বিদ্যালয়ের শিক্ষক – শিক্ষিকাদের হিমসিম খেতে হয়। মাঝে মধ্যেই মাইক প্রচারের মাধ্যমে শিক্ষক- শিক্ষিকারা শিবিরে উপস্থিত ছাত্র -ছাত্রী ও গর্ভবতী মায়েদের সতর্কবার্তা দেন।