বেঙ্গল ওয়াচ নিউজ ডেস্ক: আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগের কথা। যে সাতটি  গ্রাম নিয়ে সপ্তগ্রাম বন্দর,তার একটি গ্রাম বাসুদেবপুর।  সপ্তগ্রাম থেকে পাণ্ডুয়ার দিকে যেতে পূর্ব দিকে নেমে গেছে এক পায়ে চলা পথ , এ পথ গিয়ে মিশেছে ত্রিবেণী  যেখানে বয়ে চলেছে পুন্য তোয়া ভাগীরথী।

 

সারাদিন ধরে বহু পুণ্যার্থী মানুষ যাতায়াত করেন এই পথ ধরে। ঘন জঙ্গলে ঢাকা এ পথ আপাতদৃষ্টিতে ছায়াসুনিবিড় হলেও ,ভুক্তভোগীরা জানেন এ পথ কত ভয়ঙ্কর ! এ পথের উত্তর পারে বাঘটি গ্রাম , এই বাঘটি জয়পুর গ্রামেই বাস রঘু ডাকাতের।
এই রাস্তার পাশেই গহীন জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে রঘু ডাকাতের ডাকাতকালী মন্দির। একচূড়াবিশিষ্ট ডাকাত কালীমন্দির বিখ্যাত রঘু ডাকাতের ভাই বুধো নামক এক ডাকাত প্রতিষ্ঠা করেন। বুধো ডাকাতের প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তিটির বর্তমানে কোন অস্তিত্ব নেই। সাত ফুট উচ্চ বর্তমান বিগ্রহটির পদতলে শায়িত শিব। বুধো ডাকাতের প্রতিষ্ঠিত হলে এই কালী রঘু ডাকাতের কালী নামে জনপ্রিয় ও সিদ্ধেশ্বরী কালী হিসেবে পূজিতা হন।
বাগহাটির জয়পুরের বাসিন্দা বিধুভূষণ ঘোষ ও রঘু ঘোষ ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করে। তারা দিনের বেলা ক্ষেতমজুরের কাজ করার পর রাতে এলাকার ধনী ও প্রভাবশালীদের বাড়িতে ডাকাতি করতে বেরোত। রঘু ডাকাতের দলবল জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাতায়াতকারীদের গাছে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখত। এরপর ঢাকঢোল পিটিয়ে পুরোহিত ডেকে হত নরবলি। ল্যাটামাছ পোড়া দিয়ে কালীর পুজো হত। বর্তমানে মায়ের প্রধান ভোগ হিসেবে চলে আসছে সেই প্রথা। মন্দিরে সেবাইত সুমন চক্রবর্তী জানান ১৯৯৮ সালে এক ভয়ঙ্কর ডাকাতি হওয়ার পর মাকে আবার নতুন করে মূর্তি এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন থেকেই মায়ের মূর্তি এখনো পর্যন্ত পূজিত হয়ে আসছে। কথিকা ইতিহাস থেকে জানা যায় তৎকালে কালীবাড়ি ভাগ হয়ে যায় দুটো দলে। এক , সমাজপোষ্য গেরস্থ কালীবাড়ি; আর দ্বিতীয় , কুখ্যাত কালীবাড়ি! দ্বিতীয় দলটায় কালীবাড়ির হোতারা পেশায় ডাকাত। নেশায় কালী উপাসক। অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কালী তো আদতে শক্তিদেবী। এখন গায়ের জোরে লুঠতরাজে যারা বেঁচে থাকার ভাতকাপড় জোটায়, তারা কালীপুজো করবে না তো কে করবে? তাছাড়া অনেকে যে বলে, কালী মূলে অন্ত্যজ। সেজন্যই কালো এবং রক্তলোভী। সেটাও এই ডাকাতদের কালীপুজোর রীতিকে সমর্থন করে। রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-তেও তো দস্যু রত্নাকর ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে নরবলির জন্য এক বালিকাকে ধরে এনেছিল!

‘বাল্মীকি প্রতিভা’ হোক না কবির কল্পনা; ডাকাতে কালীবাড়ি এবং সেখানে নরবলি , বুকে রঘু ডাকাতের কালীবাড়ি এর এক জলজ্যান্ত সাক্ষী! এই কালীকে রঘু নাকি খুঁজে পেয়েছিল এক পুকুরের তলা থেকে । সেদিক থেকে দেখলে বয়সের বিচারে এই কালী সবার আগে থাকার হকদার হতেই পারে। বিপ্রদাস পিপলাই-এর ‘মনসামঙ্গল’-এও রঘু ডাকাতের কালীবাড়ির উল্লেখ আছে।
যদিও  হুগলির বাসুদেবপুরের রঘু ডাকাতও বুধো ডাকাত, প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধেশ্বরী  কালী , কলিকাতার চিৎপুরের রঘু ডাকাত প্রতিষ্ঠিত রঘু ডাকাতের চিত্তেশ্বরী কালিমন্দির ও বাঁকুড়ার রঘু ডাকাত প্রতিষ্ঠিত কালীবাঁকুড়ার কালীতলার বড়কালীর মন্দিরে। জনশ্রুতি বলে প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর আগে এখানে শ্মশানে কালীর উপাসনা শুরু করেন রঘু ডাকাত। তারপর কালীতলায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবীর।  রঘুর হাতে দেবী পূজা পেতেন ‘সর্বমঙ্গলা’ নামে। নামে অভিনব হলেও মূর্তি প্রথানুগ। খড়্গ ও মুণ্ডধারিণী এবং অভয়া বরদা! ডাকাতের দেবী হলেও এবং তাঁর প্রসাদে বহু পরিবারের রঘু সর্বনাশ করলেও কালী কিন্তু সত্যই সর্বমঙ্গলা। রঘু লুঠপাট করত গরিবকে সুখে রাখার জন্য- নিজস্ব স্বার্থ তার প্রায় ছিল না বললেই হয়। সেই জন্যই তৎকালের পূর্ববঙ্গের রামশরণ সিমলাই নামে এক বণিক যখন বাণিজ্যপথে বজরা থামিয়ে এই দেবীর পুজো দেয়- তখন রঘু তার গায়ে আঁচড়টিও না কেটে তাকে ফিরে যেতে দিয়েছিল। সম্ভবত উচ্চবর্ণের স্বীকৃতিই রঘুকে দুর্বল করে ফেলে। ইংরেজদের হাতে ধরা দেওয়ার সময়ে হয়ত তাই মন্দির এবং সব দেবোত্তর সম্পত্তি রঘু লিখে দিয়ে যায় সিমলাইকেই।প্রসঙ্গত জানাই বাসুদেবপুর অঞ্চলেওএকটি কালী মন্দিরে মা কালী চিত্তেশ্বরী নামে পূজিতা হন।
যাই হোক প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে ভবানী পাঠক, রঘু ডাকাত বা বিশে ডাকাতের ভাবমূর্তি ছিল অত্যন্ত ভাল। এদের পরোপকারী রবিন হুড ইমেজের জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে এদের প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা ছিল। তাই এরা যখন চলে গেল, স্থানীয় মানুষজন ওদের পরিত্যক্ত কালীমন্দিরগুলিতে সাড়ম্বরে পুজোপাঠ শুরু করে দিলেন। আর সঙ্গে একটা অতীত ইতিহাস থাকাতে এ সব পুজো ‘ডাকাতে কালী’রা বিখ্যাত হয়ে উঠলেন।”
মাতৃভক্ত সাধক রামপ্রসাদ ত্রিবেণী থেকে একটু দূরেই গঙ্গার হালিশহরের বাসিন্দা ছিলেন। কোনো এক সময় তিনি এই পথ ধরে ত্রিবেণী খেয়াঘাটে যাবার পথে, রঘু ডাকাতদের খপ্পরে পড়েন।ডাকাতদল তাঁকে মায়ের সামনে বলি দেবার জন্য ধরে আনে , হাড়িকাঠে চড়ানোর  আগে রামপ্রসাদ মা কে গান শোনানোর আর্জি জানান।  পেশায় নিষ্ঠুর ডাকাত হলেও রঘু ডাকাত ছিল একজন কালী সাধক, তিনি  মা কে গান শোনানোর আবেদন মঞ্জুর করলেন । কথিত আছে মোহিত হয়ে রামপ্রসাদের শ্যামাসংগীত শুনতে শুনতে রঘু দেখেন হাড়িকাঠে রামপ্রসাদের পরিবর্তে মায়ের মুখ ! কালীসাধক রঘু ডাকাত সঙ্গে সঙ্গে বলি বন্ধ করে রামপ্রসাদের সেবার বন্দোবস্ত করেন। পরদিন রামপ্রসাদকে নৌকাযোগে বাড়িতে পৌঁছে দেন।
এরপর রঘুর জীবনে এক পরিবর্তন ঘটে ,তিনি নৃশংস ডাকাতি,ও মানুষবলি ত্যাগ করেন। গ্রামবাসীদের কাছে সে হয়ে ওঠে ভগবানসম।
একটা সময় ছিল যখন নরবলি ও ল্যাটামাছ পোড়া দিয়ে পুজো দিয়ে ডাকাতির উদ্দেশে রওনা দিত রঘু ডাকাত ও তার দলবল। আজ আর সেই দিন নেই। তবে, কালীপুজোর দিনে এখনও চল রয়েছে ল্যাটামাছ পোড়া দেওয়ার। আর তা মহাপ্রসাদ হিসেবে নিতে দূরদূরান্ত থেকে বহু ভক্ত এসে ভিড় জমান রঘু ডাকাতের কালীমন্দিরে।
এবছর নতুন করে নির্মিত হচ্ছে বহু যুগ আগেকার রঘু ডাকাতের কালি বাড়ির নির্মাণ কার্য। স্থানীয় এক বাসিন্দা কার্তিক ভৌমিক জানান দাদু বাবার থেকে এই মন্দির এবং মায়ের কথিত ইতিহাস ও মায়ের মাহাত্ম্য বিভিন্ন দিক দিগন্তে ছড়িয়ে আছে। কালী পুজোর দিন রাতে প্রথাগত নিয়ম মেনে মশাল জেনেই বর্তমানেও বলি প্রথা হয়ে আসছে। হাজার হাজার ভক্ত সমাগম হয় ওই রাতে। নতুন ভাবে মায়ের মন্দিরে নির্মাণ কার্য শেষ হলে প্রাচীন কথার মাহাত্ম্য মানুষের মধ্যে যুগ যুগান্তর হতে গেঁথে থাকবে মনে ও মননে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *