বেঙ্গল ওয়াচ নিউজ ডেস্ক: গ্ৰামীণ হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া উত্তর বিধান সভা কেন্দ্রের আমতা ১ নং পঞ্চায়েত সমিতির অন্তর্গত রসপুর গ্ৰাম পঞ্চায়েতের অধীন ১৪৭ বছরের প্রাচীন রসপুর উচ্চ বিদ্যালয় -র প্রাক্তন ছাত্র সমিতির ৭৮ তম পুর্নমিলন উৎসব অনুষ্ঠিত হল রডা কোম্পানির অস্ত্র লুন্ঠনের মূল কান্ডারী রসপুর গ্ৰাম নিবাসী শ্রীশচন্দ্র (হাবু) মিত্র স্মৃতি সৌধ রসপুর পিপলস লাইব্রেরীর পাশে আমতা ১ নং ব্লক ফ্লাড রেসকিউ সেন্টারের মুক্ত মঞ্চে।
১৮৫৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পর যখন পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এদেশে ইংরাজী শিক্ষা প্রচলনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন,সে সময় দামোদর নদের অপর পাড়ে গড়ভবানীপুরে জমিদার রায় প্রতিষ্ঠিত একটি ইংরাজী বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে আসেন।
এই ঘটনা তখন রসপুর ও কলিকাতা গ্ৰামের যুবকদের বিশেষ ভাবে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করে।তারা কলিকাতা গ্ৰামের মন্ডল বাড়িতে শিক্ষিত এবং উদার মনের ব্যবসায়ী অঘোর নাথ মন্ডলের কাছে বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব রাখেন।শিক্ষা- সংস্কৃতি – সমাজ কল্যাণে অঘোর নাথ মন্ডল যুবকদের প্রস্তাব সানন্দে গ্ৰহণ করেন।
স্বাধীনতার ৭১ বৎসর পূর্বে যুবকদের প্রস্তাবের মান্যতা দিয়ে অঘোর নাথ মন্ডল এবং ভাই উদয় চাঁদ মন্ডল এবং কলিকাতা ওরিয়েন্টাল স্কুলে শিক্ষা প্রাপ্ত ভাইপো অনুকূল চন্দ্র মন্ডলের সাহায্যে ১৮৭৬ সালে বিদ্যালয় স্থাপনের কাজ শুরু করেন। প্রথমে আনুমানিক ৩ কাঠা জমির উপর খড়ের চালের মাটির ঘর বানিয়ে শুরু হয় বিদ্যালয়।সে সময় এটি একটি মিডল ইংলিশ স্কুল ছিল।যাদব চন্দ্র রায়,মহেশ চন্দ্র দাস,রাখাল চন্দ্র দেয়াশী এবং শশীভূষণ রায় এ সময় খুবই অগ্ৰণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার উন্নতির জন্য অঘোর নাথ মন্ডল ১ বিঘা জমি ক্রয় করে তাতে ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন পিপলস্ লাইব্রেরী।যাদব চন্দ্র রায় স্কুলের জন্য ১০ কাঠা জমি দান করেন।১৮৯৫ সালে স্কুলের পশ্চিম দিকের ঘরে রসপুর পোস্ট অফিস শুরু হয়।১৮৯৩ সালে রসপুর বিদ্যালয়টি হাই সেকেন্ডারি শিক্ষাক্রমের জন্য অনুমোদন লাভ করে।অবনীকান্ত রায় বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ১২ শতক জমি দান করেন। এছাড়া বিদ্যালয়ের খেলার মাঠের জন্য শ্রী গোবিন্দ্র চন্দ্র কোলে ২৮ শতক জমি দান করেন। প্রথমে প্রাথমিক বিদ্যালয় তারপর ধীরে ধীরে জুনিয়র হাই, মাধ্যমিক বতর্মানে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়ে রসপুর উচ্চ বিদ্যালয় হয়েছে।
ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ১ বৎসর পূর্বে ১৯৪৬ সালে শিক্ষানুরাগী কয়েকজন ব্যক্তি উপলব্ধি করেন বিদ্যালয়ের আর্থিক অনটনের জন্য বিদ্যালয়ের গৃহ সংস্কার ঠিকমত করা যায় নি।শিক্ষকরা যৎসামান্ন মাহিনা পেতেন। তৎকালীন বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির সদস্যগণ বিদ্যালয়ের সুরক্ষা এবং উন্নতির জন্য বিদ্যালয়ে একটি প্রাক্তন ছাত্র সমিতি গঠন করেন।এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাগণের বংশধর শিক্ষানুরাগী, ছাত্র দরদী মম্মথনাথ মন্ডল।১৯৪৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন সময়ের এই প্রাক্তন ছাত্র সমিতির যারা সদস্য হয়েছিলেন তাদের নিয়ে পুর্নমিলন উৎসবের আয়োজন করেছিলেন।২৫ ডিসেম্বর প্রাক্তন ছাত্র সমিতির জম্মদিন হিসাবে পালন করা হয়।২৫ ডিসেম্বর পুর্নমিলন এর স্রোত আজ ও প্রবহমান।
এই সমিতির পথ চলার সময় কোন কোন সময়ে ছাত্র সমিতির সভাপতি,সহ সভাপতি, সম্পাদকের মৃত্যুতে সমিতির পথ চলতে অসুবিধা হলেও পথ চলা থেমে নেই।নানা ঘাত প্রতিঘাত,বাধা – বিঘ্নর মাঝেও ২৫ ডিসেম্বর পুর্নমিলন উৎসব পালিত হয়ে চলেছে।২০২৩ এই সমিতির ৭৮ তম পুর্নমিলন উৎসবে বহু শিক্ষানুরাগী,শিক্ষাদরদী, সংস্কৃতি প্রেমী, প্রশাসনিক ব্যক্তিত্বকে সমিতির পতাকা তলে হাজির করতে পেরেছে। সমিতির এটা গর্বের বিষয়।
ভারতবর্ষের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের পর বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু রসপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র সমিতির পুনর্মিলন উৎসব এর তারিখ পরিবর্তন হয় নি।১৯৪৬ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চিরাচরিত প্রথা মেনে রসপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র সমিতির পুনর্মিলন উৎসব হয়ে আসছে। এই বৎসর রসপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র সমিতির ৭৮ তম বর্ষপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠিত হল রডা কোম্পানির অস্ত্র লুন্ঠনের মূল কান্ডারী রসপুর গ্ৰাম নিবাসী শ্রীশচন্দ্র (হাবু) মিত্র স্মৃতি সৌধ রসপুর পিপলস লাইব্রেরীর পাশে আমতা ১ পঞ্চায়েত সমিতির ফ্লাড রেসকিউ সেন্টারের মুক্ত মঞ্চে।
পুনর্মিলন উৎসবের শুভ সূচনা করেন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে সমিতির বর্ষীয়ান সদস্য ও সভাপতি তথা স্বাধীনতা সংগ্ৰামী চন্ডীচরণ দাস। সমিতির পতাকা উত্তোলন করেন সমিতির কার্যকরী সভাপতি মাধবানন্দ চক্রবর্তী। উপস্থিত প্রাক্তনীদের শপথ বাক্য পাঠ করান সমিতির কোষাধ্যক্ষ শক্তিসাধন কোলে।রডা কোম্পানির অস্ত্র লুন্ঠনের মূল কান্ডারী রসপুর গ্ৰাম নিবাসী শ্রীশচন্দ্র (হাবু) মিত্রর উদ্দেশ্যে নির্মিত শহীদ স্মৃতি সৌধ এ মাল্যদান ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন উপস্থিত অতিথিবৃন্দ, সমিতির সদস্য -সদস্যা ও দর্শকবৃন্দ। রসপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র সৌরভ রায়(বুবাই) যিনি সমাজসেবা করতে গিয়ে পথ দূর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন তার স্মৃতি স্তম্ভে মাল্যদান ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়।
৭৮ তম পুর্নমিলন উৎসবের মূল আকর্ষণ ছিল সম্বর্ধনা। সমিতির বর্ষীয়ান সদস্যবৃন্দ বতর্মান আমতা থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার ইনচার্জ অজয় সিং এর কর্মদক্ষতা,ব্যবহারিক আচার আচরণ, সর্বপরি ওনার সুস্থ সংস্কৃতির প্রেমে মুগ্ধ হয়ে ওনাকে সম্মাননা জানানোর সিদ্ধান্ত নেন।
সম্মাননা গ্ৰহণ করে আমতা থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার ইনচার্জ অজয় সিং বলেন, একটি শতবর্ষ প্রাচীন বিদ্যালয় যে আগামী ৩ বৎসর পর দেড় শতবর্ষে পদার্পন করবে, সেই বিদ্যালয়ের ৭৮ বৎসরের প্রাক্তন ছাত্র সমিতির কাছ থেকে এই সম্মাননা পাওয়া তার জীবনের বড় পাওনা। এই সম্মাননা ওনার কর্মজীবনে দায়িত্ব ও কর্তব্য আরও বাড়িয়ে দিল। তিনি বলেন, বতর্মানে ছাত্র – ছাত্রীরা মানবিক মূল্যবোধ হারাচ্ছে।তারা নিজেদের গ্ৰাম সম্পর্কে জানতে আগ্ৰহী নয়।তারা পাঠ্যপুস্তক ছাড়া অন্য বই পড়ার প্রতি আগ্ৰহী নয়।তারা ইন্টারনেটে ব্যস্ত। তিনি ছাত্র -ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ইন্টারনেটে সব পাওয়া যায় না,যা পাওয়া যাবে বইয়ে।
এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমিতির কার্যকরী সভাপতি মাধবানন্দ চক্রবর্তী,যুগ্ম সম্পাদক জলধর বাগ, রসপুর গ্ৰাম পঞ্চায়েতের প্রধান অর্জুন দলুই, উপপ্রধান রাজকুমার খাঁড়া, সমাজ সেবী ও প্রাক্তন ফুটবলার বনমালী পাত্র, সমাজ সেবী মুস্তাক আলি মন্ডল প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিদের হাত ধরে সমিতির মুখপাত্র ‘পূর্বসুরী ‘ র ৭৮ তম সংখ্যার মোড়ক উন্মোচিত হল।
অনুষ্ঠানটি প্রাক্তন ছাত্র সমিতির যুগ্ম সম্পাদক অসীম কুমার মিত্র ও সহ সম্পাদক তথা সমাজসেবী অতনু মন্ডলের সঞ্চালনায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠে।