বেঙ্গল ওয়াচ নিউজ ডেস্ক: আজ, ১৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বকর্মা পুজো। সারা ভারত তো বটেই ভারতের বাইরে যেখানেই হিন্দুদের বসবাস সেখানেই দেবতা বিশ্বকর্মার আরাধনা হয়।

 

প্রথমেই আমাদের মনে একটা প্রশ্ন আসে যে, হিন্দুদের অন্যান্য পুজো বিভিন্ন তিথিতে হলেও কেন বিশ্বকর্মা পুজো প্রতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বরই হয়। প্রথমেই পরিষ্কার করা ভালো যে, হিন্দুদের অন্যান্য সমস্ত পুজোর তারিখ নির্বাচন করা হয় চাঁদ ও নক্ষত্রের অবস্থানের উপর। একমাত্র বিশ্বকর্মা পুজো ঠিক করা হয় সূর্যের অবস্থানের উপর। সূর্যের গতি অনুসরণ করলে দেখা যায়, কন্যা রাশিতে সূর্যের গমন হয় সংক্রান্তি তিথিতে। শাস্ত্র অনুসারে, সেই দিনেই জন্ম হয়েছিল দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার। তাই সেই দিনটিতে বিশ্বকর্মার আরাধনা করা হয়। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে সেই দিনটি হয় ভাদ্র মাসের শেষ তারিখে। আবার এই ভাদ্র মাসের আগে বাংলা পঞ্জিকায় পাঁচটি মাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। যার মোট দিন সংখ্যা ১৫৬। তাই আজ ১৭ সেপ্টেম্বর উদযাপিত হতে চলেছে বিশ্বকর্মা পুজো।

বিশ্বকর্মা একজন বৈদিক দেবতা। ঋগ্বেদ অনুযায়ী, তিনি পরম সত্যের প্রতিরূপ এবং সৃষ্টিশক্তির দেবতা। ঋক বেদে বিশ্বকর্মাকে সময়ের সূত্রপাতের প্রাক্‌-অবস্থা থেকে অস্তিত্বমান স্থপতি তথা ব্রহ্মাণ্ডের দিব্য স্রষ্টা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ঋগবেদের ১০ম মণ্ডলে ৮১ এবং ৮২ সূক্তদ্বয়ে বিশ্বকর্মার উল্লেখ আছে। ঋগবেদ অনুসারে তিনি সর্বদর্শী এবং সর্বজ্ঞ। তার চক্ষু, মুখমণ্ডল, বাহু ও পদ সবদিকে পরিব্যাপ্ত। তিনি বাচস্পতি, মনোজব, বদান্য, কল্যাণকর্মা ও বিধাতা অভিধায় ভূষিত। তিনি ধাতা, বিশ্বদ্রষ্টা ও প্রজাপতি। তিনিই এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। তিনিই বিশ্বের আদি স্থপতি শিল্পী। তাঁর স্থাপত্যের নিদর্শন আছে আমাদের পুরান, রামায়ণ ও মহাভারতে। রামায়ণে একাধিক স্থলে বিশ্বকর্মার উল্লেখ পাওয়া যায়। আদিকাণ্ডে উল্লিখিত হয়েছে, বিশ্বকর্মা দুটি ধনুক নির্মাণ করেছিলেন। তিনি তার মধ্যে একটি ত্রিপুরাসুর বধের জন্য শিবকে এবং অপরটি বিষ্ণুকে প্রদান করেন। বিষ্ণু তার ধনুকটি প্রদান করেন পরশুরামকে। রাম শিবের ধনুকটি ভঙ্গ করে সীতাকে বিবাহ করেন এবং অপর ধনুটিতে জ্যা আরোপ করে পরশুরামের দর্প চূর্ণ করেন। রামায়ণে উল্লিখিত বিশ্বকর্মার স্থাপত্যকীর্তিগুলি হল – কুঞ্জর পর্বতের ঋষি অগস্ত্যের ভবন,রামায়ণ, কৈলাস পর্বতে অবস্থিত কুবেরের অলকাপুরী, রাবণের লঙ্কা নগরী। এছাড়াও বলা হয়, তিনি বিশ্বভুবন নির্মাণ করেন। বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিব এর ত্রিশূল, কুবের এর অস্ত্র, ইন্দ্রের বজ্র, কার্তিকেয়র শক্তি প্রভৃতি তিনি তৈরি করেছেন। শ্রীক্ষেত্রর প্রসিদ্ধ জগন্নাথ মূর্তিও তিনি নির্মাণ করেছেন।

বিশ্বকর্মা পূজা হয় ভাদ্র সংক্রান্তিতে অর্থাৎ ভাদ্র মাসের শেষ দিনে। আর এই দিনেই হয় রান্নাপুজো বা অরন্ধন যা কিনা মনসাপূজার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিশ্বকর্মার হাতে দাঁড়িপাল্লা থাকে। দাঁড়িপাল্লার দুটি পাল্লা জ্ঞান ও কর্মের প্রতীক হিসাবে ধরা হয়। উভয়ের সমতা বজায় রেখেছেন তিনি। এছাড়া তিনি হাতুরী ধারণ করেন, যা শিল্পের সাথে জড়িত। তিনি যে শিল্পের দেবতা এই হাতুরী তারই প্রতীক।

এবার এ বছরের বিশ্বকর্মা পুজোর কথায় আসা যাক। বাঙালির কাছে বিশ্বকর্মা পুজো মানেই দুর্গাপুজোর ঘণ্টা বেজে গেল। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার আরাধনা যেন এই বঙ্গভূমিতে নিয়ে আসে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উত্‍সব দুর্গাপুজোর আগমন বার্তা। আজ ১৭ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে বিশ্বকর্মা পুজো। সাধারণত বেশিরভাগ কল-কারখানায় বিশ্বকর্মার পুজো হলেও এখন যেকোনো শিল্প কর্মের সঙ্গে যুক্ত সকলেই বিশ্বকর্মার আরাধনায় মেতে ওঠেন।

২০২৪ সালে বিশ্বকর্মা পুজোর তিথি নিয়ে গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকার মত বলছে, ৩১ ভাদ্র পড়ছে ১৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার। তিথি ভাদ্র শুক্লপক্ষের চতুর্দশী বেলা ১১টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত থাকবে। মঙ্গলবারই শ্রীশ্রী বিশ্বকর্ম পুজো রয়েছে বলে মত গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকার। এই উৎসবের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এই দিনে মেশিন, যানবাহন ও কলকারখানার পুজো করা হয়। পুরান মতে, ষোদপুচার (১৬ উপাচার)পদ্ধতিতে বিশ্বকর্মা পুজো করা উচিত । এই পদ্ধতিতে পুজো করলে ভগবান বিশ্বকর্মা খুব খুশি হন এবং সব কাজে উন্নতি হয়। বিশ্বকর্মা তুষ্ট হলেই কাটবে আর্থিক সঙ্কট, ঘরে থাকবে সুখ-শান্তি৷ এই ১৬ উপাচার হলো – সুপারি, রোলি, হলুদ অশ্বগন্ধা, হলুদ, লবঙ্গ, মৌলি, কাঠের পদ, হলুদ কাপড়, মাটির পাত্র, নবগ্রহ, পবিত্র সুতো, এলাচ, সুগন্ধি, শুকনো নারকেল, নারকেল। এছাড়াও ভগবান বিশ্বকর্মা পূজার জন্য ধূপকাঠি, অক্ষত ফল, মিষ্টি, কর্পূর, দেশি ঘি, হবন কুণ্ড, আম কাঠ, দই, ফুল এবং শসা অবশ্যই পুজোর সময় রাখা উচিত। হিন্দু ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাস, বিশ্বকর্মা মানুষকে কর্মঠ, পরিশ্রমী করেন ও কাজের দিশা দেখান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *