বেঙ্গল ওয়াচ নিউজ ডেস্ক: দার্জিলিং যাওয়ার পথে সোনাদার কাছে রিংটং চা বাগান। সেখানে পাঁচ বছর ধরে কাজ করছেন রুবিনা রাই। কিছুদিন আগে তিনি ২০ শতাংশ বোনাসের দাবি জানাতে শিলিগুড়ি এসেছিলেন।

 

বলেছিলেন, ‘বাঙালিদের যেদিন দশমী, ওই সময়টায় আমাদের দশই।’ কী হয় তখন? রুবিনার আবেগী উত্তর, ‘চাল আর রং দিয়ে টিকা বানাই আমরা। ওটা আমাদের কাছে আশীর্বাদের মতো। পরিবারের ছোট-বড় সবার কপালে ওই টিকা পরানো হয়।’

নাগরাকাটার কাঁঠালধুরা চা বাগানের স্থায়ী শ্রমিক তেজকলী ওরাওঁ। স্বামী মারা গিয়েছেন। ১৮ বছর ধরে বাগানে কাজ করে একা হাতে সংসার সামলাচ্ছেন। পুজোয় গতবছর ১৯ শতাংশ বোনাস পেয়েছিলেন। এবছর ১৬ শতাংশ। তাই কিছুটা মন খারাপ। বোনাসের টাকা দিয়ে কী করবেন? তেজকলী বললেন, ‘ছেলের অ্যাডমিশনের জন্যে ওই টাকা থেকে কিছুটা সরিয়ে রাখব। নতুন জামাকাপড় কিনব ছেলের জন্য।’ আর নিজের জন্য? ‘হ্যাঁ , কম দামি কিছু একটা কিনে নেব।’

মালবাজারের রাঙ্গামাটি বাগান ডুয়ার্সের বড় চা বাগিচাগুলির একটি। সেখানে দেখা গেল একদিকে মণ্ডপ তৈরির কাজ শেষ। অন্যদিকে, পাতা তোলার পর ওজনের জন্যে শ্রমিকদের জটলা। সকলেই মহিলা। তঁাদেরই একজন গৌরী পান্না বিঘা (অস্থায়ী) শ্রমিক। পুজোয় যা যা কিনবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন, ১৬ শতাংশ বোনাসে তার সবটা কেনা সম্ভব হচ্ছে না এবার। ‘আমাদের তো ছয়-সাত মাস কাজ। তাই বোনাস অনেক কম। মাত্র ২০০০ টাকায় উৎসব পালন করা যায় বলুন?’ প্রশ্ন গৌরীর। তবে স্থায়ী শ্রমিকরা ঘরের ছোটদের জন্যে নতুন জামাকাপড় কিনবেন।

পাহাড়ের শ্রমিকরাও বোনাসের টাকা দিয়ে নতুন জামাকাপড় কেনেন। পাশাপাশি ঘরের সমস্ত কিছু যেন নতুন হয়, সেদিকটা খেয়াল রাখেন মূলত মহিলারাই। পাঙ্খাবাড়ির লংভিউ চা বাগানের শ্রমিক সংগীতা ছেত্রী বলছিলেন, ‘পর্দা, টেবিল ক্লথ, বিছানার চাদর থেকে শুরু করে সমস্ত জিনিস বোনাসের টাকা দিয়ে কিনি। দশইতে পরিবারের লোকেরা আসেন। ছোটদের টিকা পরিয়ে হাতে ২০০-৫০০ টাকা আশীর্বাদস্বরূপ দেওয়া হয়। সঙ্গে ভালো খাওয়াদাওয়া।’ তারপর হাসতে হাসতে, ‘একটু মাংস, পানীয়ও চলে।’

দশইতে গান-বাজনার পাশাপাশি ঘরদোর আলো দিয়ে সাজাতে ভালোবাসেন মার্গারেট হোপ চা বাগানের শ্রমিক প্রভা তামাং। তিনি বলেন, ‘গতবছর যা বোনাস পেয়েছিলাম তা দিয়ে দশই কাটিয়েছি।’ কিন্তু এবছর? ‘বাজেটে কিছু কাটছাঁট করতে হবে।’

কাটছাঁট হবে ডুয়ার্সেও (Dooars)। চালসায় মেটেলি বাগানের শ্রমিক মায়া মারান্ডি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। তাই পুজোয় দিনগুলো ঠাকুর দেখতে যাওয়ার খুব একটা চল নেই তাঁর পরিবারে। বোনাসের বেশিরভাগটাই সঞ্চয় করেন ডিসেম্বরের জন্যে। মেটেলি বাজার থেকে সেসময় জামাকাপড় কেনেন। ক্রিসমাসে গোট ঘর আলো দিয়ে সাজান। ‘খানাপিনা’ চলে। তবে এবারে আড়ম্বর কিছুটা কমবে, জানালেন মায়া।

দুই-তিন দশক আগেও বোনাসের (Bonus) টাকা হাতে পেলে তরাই়-ডুয়ার্সের চা শ্রমিকরা সাইকেল, রেডিও, টিভি ইত্যাদি কিনতেন। এখন সেই ট্রেন্ড বদলেছে। গতবছর বোনাসের টাকায় হোম থিয়েটার কিনেছিলেন মায়া। এবছর কম, তাই এখনও কিছু কেনার কথা ভাবেননি। তবে একটা আলমারি কেনার ইচ্ছে রয়েছে তাঁর।

বাংলায় দুর্গাপুজোর পরেই আসে লক্ষ্মীপুজো। পাহাড়ের চা বাগানে ওই সময়ে ভাইলনির আমেজ। ভাইলনি সম্পূর্ণ মহিলাদের দ্বারা পালিত উৎসব। মাথায় পাহাড়ি ফুল, নতুন জামাকাপড় পরে গান গাইতে গাইতে বাড়ি বাড়ি ঘোরেন তাঁরা। এটাই হলো তাদের উপার্জন করার পথ । সারা বছর ধরে এই আশায় বেঁচে থাকেন তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *