নোবেল বিতর্ক : পর্ব ১
*******************
তেরোর গেরোয় নোবেল পুরষ্কার,
ব্র্যান্ডিং আসক্তির জন্যই কি অমর্ত্য সেন নীরব?

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় :তেরোর গেরোয় পড়ে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হলেন শত বর্ষ থেকে মাত্র ১২ বছর দূরে থাকা বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব অমর্ত্য সেন । পিতামহ ক্ষিতিমোহন সেনের উদ্যোগে নির্মিত শান্তিনিকেতনের একটি বসতবাড়ি আছে বিশ্ববন্দিত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের । বাড়ির নাম প্রতীচি। সংবাদসূত্র বলছে, এই জমির কিছুটা বিশ্বভারতী থেকে নেওয়া লিজের জমি। কিছুটা কেনা। মোট জমি ১.২৫ একর। কিন্তু ৮০ ও ৯০ এর দশকে ভুল রেকর্ডের জন্য নথিভুক্ত হয় ১.৮০ একর।বর্তমান বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর অভিযোগ , প্রশাসনিক ত্রুটিতেই এই ভুল নথি সংরক্ষণ হয়ে আছে। তাই অমর্ত্য সেনকে বার বার চিঠি দিয়ে জানানো হয়, তাঁর অধীনে বিশ্বভারতীর ১৩ ডেসিবেল জমি অধিকৃত হয়ে আছে। তিনি যেন এই পরিমাণ জমি ছেড়ে দেন।

Vপ্রশ্ন ওঠে, শুধুই কি অমর্ত্য সেনের প্রতি বিশ্বভারতীর এই অভিযোগ? না। বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর দাবি, বিশ্বভারতীর বহু জমি প্রশাসনিক বিভাগের উদাসীনতায় চুরি হয়ে গেছে। এই সব জমির অধিকাংশ শান্তিনিকেতনের পূর্ব পল্লী এলাকায়। যেখানে বিশ্বভারতীর আধিকারিকরাই বেশি মাত্রায় থাকেন। সেখানে দখলকৃত জমিতে চলছে স্কুল, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি । বিদ্যুৎ চক্রবর্তী আরও বলেছেন,২০০৬ সালে অমর্ত্য সেন ৯৯ বছরের লিজের বসত জমিটি তাঁর নামে করে দিতে চিঠি লেখেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কাছে । এই তেরো ডেসিবেল জমি দখলের অভিযোগের সঙ্গে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী অভিযোগের মাত্রা বাড়িয়ে বলেন, অমর্ত্য সেন পণ্ডিত মানুষ নিঃসন্দেহে। কিন্তু তাঁকে যেভাবে নোবেল বিজয়ী বলা হয়, তিনি নীরব থেকে সম্মতির লক্ষণ প্রবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন । তেরো ডেসিবেল জমি বিতর্কে আজ এক বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়ল। তেরো সংখ্যাটাই নাকি অশুভ। এমনটাই পৃথিবীময় অধিকাংশ মানুষ মেনে চলেন। তেরো সংখ্যা অশুভ হিসেবে সবচেয়ে বেশি যে তথ্যটি প্রতিষ্ঠিত, সেটি হলো লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির দি লাস্ট সাপার । সেখানে বলা হয়েছে প্রভু যীশুকে রাজার সেনাদের হাতে ধরিয়ে দেন ১৩ তম শিষ্য যুদাস ইস্কারিয়ত।অতীতের এক বিশ্বনিন্দিত সিরিয়াল কিলার জ্যাক দ্য রিপারের নামের সংখ্যা ছিল তেরো।১৪ শতকে ইংরেজ কবি জিওফ্রে চাসার এর গল্পে ১৩ সংখ্যাকে অশুভ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । এহেন তেরো সংখ্যাটি অমর্ত্য সেনের নোবেল না পাওয়ার বিষয়টি সামনে নিয়ে এলো। নিন্দুকদের অনেলে বলছেন, অমর্ত্য সেন নিজেও জানেন তাঁর পুরস্কারটি নোবেল নয়। তাঁকে যখন নোবেল বিজয়ী বলা হয়, তিনি আপত্তি করেন না। অস্বীকার করার উপায় নেই, তিনি যে পুরস্কার পেয়েছেন তা বিশ্বের সেরা সাম্মানিক পুরস্কার। সেক্ষেত্রে একজন ভারতীয় ও বঙ্গ সন্তান হিসেবে আমরা গর্বিত। তাই এই পুরস্কারের যথার্থ নামটি বলতে আপত্তি কেন হবে? তাতে কোনো সম্মানহানি হয় না। নোবেল ও ব্যাংকের দেওয়া পুরস্কারের অর্থমূল্য এক।দেওয়া হয় একই মঞ্চ থেকেই। কিন্তু অর্থনীতির বিজেতাকে যে মানপত্র দেওয়া হয়, সেখানে যেমন অর্থনীতির মানপত্রে কোথাও নোবেল পুরষ্কার লেখা নেই, তেমন নোবেল পুরস্কারের পাঁচটি পদকের ডিজাইন আলাদা। অর্থনীতির পদকের ডিজাইন আলাদা। এত পার্থক্য থাকলেও নোবেল পুরস্কার এই ব্র্যান্ডিং এর প্রতি আসক্তিই অমর্ত্য সেনকে নীরব রেখেছেএমনটাই মনে করেন অনেকে।কেন্দ্রের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী মনোভাবের যিনি স্পষ্ট বিরোধিতা করেন, যিনি মমতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা আছে বলে নির্দ্বিধায় প্রকাশ্যে মত প্রকাশ করেন, তিনি তাঁর বিরূদ্ধে ওঠা নোবেল বিজয়ী নন বলে বক্তব্য যখন উঠে আসছে সেক্ষেত্রে তিনি নীরব থাকছেন কেন এই প্রশ্নও তুলছেন দেশের কিছু মানুষ । যদিও তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন, যার যা খুশি বলতেই পারেন। ড: সুবোধ রায়ও বলেছেন, তিনি বিষয়টি নিয়ে অমর্ত্য সেনকে বিষয়টি নিয়ে তাঁর লেখা একটি বইও পাঠিয়েছিলেন অমর্ত্য সেন সেই বই ডাক বিভাগ থেকে নিয়েছেন। কিন্তু ড : রায়কে প্রাপ্তি স্বীকার করে জবাব দেননি। সেই বইটি এখন অ্যামাজনে পাওয়া যাচ্ছে।দেশের শীর্ষ আদালতেও জানিয়েছিলেন। আদালত তাঁকে জানায়, শীর্ষ আদালতের এই বিষয়ে মন্তব্য করার এ্যাক্তিয়ার নেই।

ড: সুবোধ রায়ের বক্তব্য, সমসাময়িক ঘটনার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেক বিদগ্ধ মানুষ বিষয়টিকে বিতর্ক বলে একটি ভুল করছেন । ড: রায় বলেন, আমার সাথে ব্যক্তিগত ভাবে অমর্ত্য সেনের কোনো শত্রুতা নেই। তিনি সম্মানীয়। কিন্তু তিনি যে নোবেলবিজয়ী নন, সেটা কেন স্পষ্ট বলছেন না? অস্বীকার করার উপায় নেই, অমর্ত্য সেন বিশ্বের সেরা স্বীকৃতি পেয়েছেন এই পুরস্কার পেয়ে। কিন্তু এটাও পাশাপাশি সত্যি,তিনি যে পুরস্কার পেয়েছেন সেটি দ্য ব্যাংক অফ সুইডেন প্রাইজ ইন দ্য ইকনমিক সাইন্সেস ইন মেমোরি অফ আলফ্রেড নোবেল। শুধু তাই নয়, অর্থনীতিতে আজ পর্যন্ত যাঁরাই পুরষ্কার পেয়েছেন কোনোটাই নোবেল পুরষ্কার নয়। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও নোবেল পাননি।

২০১৯ সালে এই নিবন্ধকের সঙ্গে এক ইউটিউব চ্যানেলে সাক্ষাৎকারে কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে থাকা মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের পি এইচ ডি প্রাপ্ত ড: সুবোধ রায় জানান, তিনি ১৯৯৮ সাল থেকেই অর্থাৎ যে বছর নোবেল কমিটি অর্থনীতির জন্য অমর্ত্য সেনের নাম ঘোষণা করেন তখন নোবেল কমিটির থেকে পাওয়া চিঠি মারফত তিনি জানতে পারেন অমর্ত্য সেন নোবেল অধিকারী নন। সুবোধবাবুর সঙ্গে কথোপকথনের সূত্রে এবং ব্যাংক অফ সুইডেনের পাঠানো চিঠির প্রামাণ্য নথি নিয়ে এই প্রতিবেদক ২০১৯ সালে ১৬ নভেম্বর প্রকাশিত এক পাক্ষিক সংবাদপত্রে প্রতিবেদন লেখে।যেটি ড: সুবোধ রায়ের সঙ্গে ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখা। ড : সুবোধ রায় সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন,১৯৬৯ সালে ব্যাংক অফ সুইডেনের তিনশো বছর পূর্তিতে নোবেল স্মৃতিতে একটি বিশেষ পুরস্কার ঘোষণা করেন। এই পুরস্কারের সঙ্গে শুধু একটি বিষয়েই মিল। তা হলো পুরস্কারের অর্থমূল্য। নোবেল বিজয়ীরা পান আলফ্রেড নোবেলের উইল মত তাঁর ব্যাংকে জমাকৃত অর্থ থেকে পাওয়া টাকা। আর অর্থনীতির ব্যাংকের দেওয়া অর্থ দেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। সুতরাং নোবেলের উইল মত অর্থনীতি যেহেতু নেই, তাই সেটি আইনি ভাবে নোবেল পুরস্কার বলা যায় না।১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে এই বিশেষ পুরস্কারের নাম ছিল , প্রাইজ ইকোনমিক সাইন্স ডিসাইডেড টু দি মেমোরি অফ আলফ্রেড নোবেল। ১৯৭২ সালে এই পুরস্কারের নাম পাল্টে রাখা হয় ব্যাংক অফ সুইডেন প্রাইজ ইন ইকোনমিক সাইন্সেস ইন মেমোরি অফ আলফ্রেড নোবেল। প্রায় প্রতিবছরই যেন নাম পাল্টাতে থাকে। ১৯৯৩ তে এই পুরস্কারের নাম পাল্টে হয় ভেরিজরিক্স ব্যাংক ( ব্যাংক অফ সুইডেন ) প্রাইজ ইন ইকোনমিক সাইন্সেস ইন মেমোরিজ অফ আলফ্রেড নোবেল । এখনও এই নামে পুরস্কারটি দেওয়া হয় ওই নোবেল পুরস্কারের মঞ্চ থেকেই। ড : সুবোধ রায়ের বক্তব্য, একই মঞ্চ থেকে বি এস সি ও এম এস সি ডিপ্লোমা প্রদান করা হয়। তার মানে দুটি শিক্ষাক্রম এক ?

নাইট্রো গ্লিসারিন ও ডিনামাইট সহ বহু বিস্ফোরকের আবিষ্কর্তা সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল। একবার আলফ্রেড নোবেলের ভাই মারা যাওয়ার পর ফ্রেঞ্চ মিডিয়া ভুল করে ঘোষণা করে আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যু সংবাদ । শিরোনাম লেখা হয় ‘মার্চেন্ট অফ ডেথ ইজ ডেড।’ সম্বিত পেলেন আলফ্রেড নোবেল। বুঝলেন, তাঁর বিস্ফোরক আবিষ্কার বিশ্বে নির্মাণের চেয়ে ধ্বংসে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি জীবনে যা রোজগার করেছেন সেই অর্থে লেগে আছে রক্তের দাগ। প্রায়শ্চিত্তের জন্য তিনি জীবনের সঞ্চিত ধনের ৭০ লক্ষ ডলার দিয়ে ব্যাংক অফ সুইডেনে একটি ফিক্সড ডিপোজিট করেন। একটি আইনি উইল সম্পাদন করে বলে যান, তাঁর এই সঞ্চয় থেকে প্রতি বছর একটি কমিটির সিদ্ধান্তে চিকিৎসা বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য ও বিশ্ব শান্তিতে একটি মানপত্র, একটি স্বর্ণ পদক ও নগদ ও ৯ মিলিয়ন ডলার আর্থিক মূল্য যেন দেওয়া হয়।

১৯০০ সালে এই পুরস্কারের নিয়মাবলী তৈরির জন্য নোবেল ফাউন্ডেশন গঠিত হয়। কমিটির সিদ্ধান্ত হয় , পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়নের শ্রেষ্ঠদের নির্বাচন করবেন সুইডিশ রয়েল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস। শারীর বিজ্ঞানে বিজেতা নির্বাচন করবেন স্টকহোমের ক্যারোলিনসন মেডিকো সার্জিকাল ইনস্টিটিউট । সাহিত্যের বিজেতা বাছার দায়িত্ব পায় সুইডেনের স্টকহোম সুইডিশ অ্যাকাডেমি। বিশ্ব শান্তির শ্রেষ্ঠত্বের জন্য জয়ী প্রার্থীর নির্বাচনের ভার ন্যস্ত হয় নরওয়ে পার্লামেন্টের পাঁচ সদস্যের।

যখন আলফ্রেড নোবেল এই উইল করেন, তখন নরওয়ে ও সুইডেন এক দেশ ছিল। দেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল স্টকহোম ও অসলো। এখন দুই বিভক্ত দেশের দুই রাজধানী । ফলে উইলের আইনি কারণে শুধু শান্তি পুরস্কার দানের দায়িত্ব পেয়েছে নরওয়ে। এই পুরস্কারটিও দেওয়া হয় নরওয়ের রাজধানী অসলোতে। নোবেল পুরস্কার নিয়ে এই প্রথম বিতর্ক , তা কিন্তু নয়। প্রথম থেকেই নোবেল পুরষ্কার প্রাপক নির্বাচন নিয়ে এবং নোবেল কমিটির স্পন্সর প্রভাব নিয়েও অভিযোগ আছে । শুনলে অবাক হবেন, জার্মানের হিটলারও নাকি শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আগেই নোবেল পাওয়ার কথা ছিল বঙ্গতনয় বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের । কিন্তু তিনি পাননি। ফ্রান্সের সেরা প্রতিভা জাঁ পল সাত্রে নোবেল পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েও প্রত্যাখ্যান করেন। বার্নড শও নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেও পরে নেন স্রেফ টাকার জন্য।সেই টাকার পুরোটাই তিনি দান করে দেন ইংরেজিতে বিদেশি সাহিত্য অনুবাদের জন্য।
( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here