ভাস্কর ঘোষাল  :   সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল ত্রয়ীর পরে বাংলা সংস্কৃতি জগতের নতুন কালপুরুষ।

জগৎসংসার তাঁকে  ছবি করিয়ে হিসাবেই চিনবে; জানবে সিনেমায় তার নতুন ভাষা দেওয়ার গল্প।

সে কেবলই গল্প বলে। জীবনের গল্প। আটপৌরে জীবন থেকে যে গল্পগুলো উঠে এসে কল্পনার জালে বন্দি হয় অবশেষে। কখনও আবার প্রকৃত ঘটনার বর্ণনা করে সে। আমরা সকলে জানি তাঁর কলমের সাবলীল চলাচলের কথা। তাঁর লেখা চিত্রনাট্যে বাংলা ভাষার নতুন দিকের উন্মোচন ঘটে। কলম কোনও নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনা। সিনেমার প্রাচীর অতিক্রম করে সহজে পৌঁছে যায় প্রকাশনা জগতে।

সম্পাদক ঋতুপর্ণ ঘোষ।

এর আগে জীবনে এক স্লিপও রিপোর্ট না লিখে, একটা ফিচারের Proof Copy না কেটেও সটান সম্পাদক। তাও কী- বাংলা ভাষার সব থেকে প্রভাবশালী প্রকাশনা গোষ্ঠীর সব থেকে প্রভাবশালী সিনে ম্যাগাজিন – এর সম্পাদক। অভিজ্ঞতা বলতে বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান রেসপন্স-এ বছর দশেক কপি লেখা আর ঝোলায়, সাকুল্যে গোটা তিনেক সিনেমা।  যদিও তার দুটি তারই মাঝে পেয়ে গেছে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান। এই সম্বলমাত্র পাথেয় করে ঋতুপর্ণ বাংলা কাগজ সম্পাদনায় তৈরি করলেন নতুন রাজপথ।

ঋতুপর্ণ যখন সিনে ম্যাগাজিন -এর ভার নিলেন তখন প্রভাবশালী বাংলা কাগজের সাদা বাড়িতে
সম্পাদকের মেলা। রথী-মহারথী সমারোহ।
তার মাঝে মধ্য তিরিশের ঝকঝকে যুবক ঋতুপর্ণ যেন এক ‘হংস মধ্যে বক যথা’। তবু বাংলা কাগজ পেল এক নতুন সম্পাদকীয় ভাষ্য। তার নামটাও সিনেম্যাটিক, ‘টেক ওয়ান’। অপর্ণা সেন কিছু কাল আগেই বাকবদলের দিশা দিয়েছেন সম্পাদকীয়তে।  এবার তা যেন পূর্ণতা পেল ঋতুপর্ণ-র হাত -এ। সুস্বাদু, মেট্রোসেক্সুয়াল গদ্য। তার সঙ্গে পার্সোনাল টাচ।
ফিচারগুলো রঙিন হলো এমন ব্লার্বে যা বাংলা কাগজ আগে কখনো দেখেনি। আর ঋতুপর্ণ ঘোষের নেওয়া সাক্ষাৎকার মানেই যেন বিস্ফোরন। সম্পূর্ণ নতুন কোন অ্যাঙ্গেল। তীক্ষ্ন, বুদ্ধিদীপ্ত, আনকাট।

সাত বছর ধরে বাঙালি পেল এক নতুন স্বাদ। বাংলা সিনে ম্যাগাজিন -এর ‘গেটাপ ‘ যে এমন হতে পারে তা এতদিন ছিল অকল্পনীয়। টেস্ট তৈরি করে দিলেন ঋতুপর্ণ।

এরপর আচমকাই নিজেই নিলেন কিছুদিনের বিরতি।

 
২০০৬-এর ২৪ ডিসেম্বর ঋতুপর্ণ ফিরলেন। নতুন  ম্যাগাজিনে, নতুন দফতরে। বাংলা প্রথম শ্রেণির দৈনিকের প্রতি রবিবার প্রকাশিত ম্যাগাজিনে। পূর্ণ দায়িত্বে। শুরু হল নতুন রূপে আবার পথ চলা । শেষ লেখা ছাপা হল দোসরা জুন, ২০১৩। তার দুদিন আগেই ৩০ মে ঋতু মুছে দিলেন দৃশ্য-অদৃশ্যের ভেদ রেখা।

পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, গীতিকার, ছড়াকার, বিজ্ঞাপন ও তথ্যচিত্র নির্মাতা, কপিরাইটার, আবৃত্তিশিল্পী, টেলিভিশন অ্যাংকর, অভিনেতা-এতসব পরিচয় ছাপিয়েও কেন বাংলা প্রকাশনার ইতিহাসে জ্বলজ্বল করবেন ঋতুপর্ণ ঘোষ? এর উত্তর পাওয়া যাবে ওই ম্যাগাজিনের প্রায় তিনশ সংখ্যায়, প্রতি পাতায় পাতায় ।

ভীষণ আটপৌরে প্রসঙ্গও যে কত অ্যাঙ্গেলে দেখা যায়, তার হাজার হাজার নজির ছড়িয়ে আছে এই ম্যাগাজিন-এর সংখ্যায়। ব্রত, নাইট ডিউটি, লেডিজ হোস্টেল, গোরস্থান, আল্পনা, পরিযায়ী, সোনা, কবচ, কদম, মেঘ, কাবুলিওয়ালা, পদ্ম, পাটালি, টাইম টেবল এমনসব সামান্য বিষয় নিয়েও যে আস্ত একেকটা পত্রিকা বানানো যায়; আর দেখার গুণে, লেখার গুণে তা যে হয়ে উঠতে পারে আলো ঠিকড়ানো মনিকাঞ্চন, তা কে কবে ভেবেছে ঋতুপর্ণ ছাড়া?

আর এই সবগুলো সংখ্যায় প্রথম লেখাটাই তাঁর। এবারের শিরোনাম ‘ফার্স্ট পার্সন’। এই লেখাগুলোয় ঋতুপর্ণ-এর বিশেষত্ব ছিল দুটো। এক, তাঁর ইস্যুকে অ্যাড্রেস করার ক্ষমতা। দুই, মনিমুক্তোর মত গদ্য। যা কেবল কবিতার কাছে কাম্য ছিল একদিন।  শত কাজের ভিড়ে তার লেখা, সম্পাদনা। একি তার ১০ বছর বিজ্ঞাপনী অতীতের কারণে? শব্দ মেপে প্রিসাইজ কম্যুনিকেশনের যে বিজ্ঞাপনী অভিজ্ঞতা, তাই কি ঋতুপর্ণকে  দিয়েছিল অনন্য, অভিনব লোকপ্রিয় গদ্য?

দখল ছিল মিথে, লোককথায়, প্রবাদ-প্রবচনে। চূড়ান্ত মড কোনো ইংরেজি কিংবা ফরাসি শব্দের সঙ্গে সনাতনী বাংলা মিশিয়ে দিতে পারতেন অবলীলায়। আর  ইস্যুকে অ্যাড্রেস করবার ক্ষমতা, অনেক পোড় খাওয়া  বার্তা সম্পাদককেও হার মানায়। সিগনেচার সম্পাদকীয়র মূল জাদু ছিল শেষ লাইনে। একদম ওস্তাদের মার শেষ রাতের মতো নিয়ম মেনে।

“বড় মধুর, বড় চমৎকার একটা বাংলা শব্দ ছিল আমাদের অভিধানে- ঝি। মানে মেয়ে। অন্দরমহলের পুরুষতন্ত্র সেই এক মাথা চুল, বড় বড় চোখের শব্দটার হাতে কবে যেন ন্যাতা বালতি ধরিয়ে দিয়েছে। খুব বেশিদিন লাগবেনা। আগামী যুগের বাংলা অভিধানে কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো উন্নয়নের মানে লেখা হবে ‘উৎখাত’। (এটা সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম ঘটনার প্রেক্ষিতে লেখা)

পাংচুয়েশন অদলবদল করে কোনও একটা লেখার অর্থের পরিবর্তন ঘটাতেন অনায়াসে। অনেকটা খেলার ছলে করতেন এই কাজ। সিনে ম্যাগাজিনের সম্পাদকের ঘরে টেবিলের উল্টো দিকে বসে এই কাজ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার অনেক বার। প্রচুর অপ্রচলিত, অব্যবহৃত বাংলা শব্দ আকছার ব্যবহার করতেন ঋতুপর্ণ।  অথচ তার প্রয়োগ করতেন চূড়ান্ত নাগরিক গড়নে। যেমন- ঋতুপর্ণ লিখছেন ।

“হ্যা, আমি ‘প্রিটি প্রিটি’ ছবি করি। আমার প্রতিটি চরিত্র সুবেশ। প্রতিটি কক্ষ সুরম্য। প্রতিটি দৃশ্য মনোহর।”

এই যে তৎসম, তদ্ভব, অপ্রচলিত শব্দের এমন সহজ সরল ব্যবহার এ কবে ছিল ঋতুপর্ণের আগে? আসলে তাঁর দেখার চোখই ছিল স্বতন্ত্র।
আর বিশ্লেষণের অভাবনীয় কারুকীর্তি। প্রতি লেখার শেষে টান টান চিত্রনাট্যের অনিবার্য মোচড়। অথচ এই সাপ্তাহিক কলমে  ক্রমাগত ঋতুপর্ণ অনুশীলন করে গেছেন নম্রতার, সহাবস্থানের। অন্বেষণ করেছেন মাধুর্য।  বিষ্মিত, বিপন্ন, প্রতিবাদী, আনন্দিত, বাউন্ডুলে, গৃহস্থ সর্বোপরি নিজের শর্তে বাঁচা সৎ ও আন্তরিক ঋতুপর্ণের ব্যক্তিগত অনুভবই তার সম্পদকীয় সাহিত্য ‘ফার্স্ট পার্সন’।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here