ভাস্কর ঘোষাল  :  কোঁকড়ানো চুল, চোখভর্তি মেধা আর মনভর্তি নানা গল্প! সমসাময়িকদের তুলনায় প্রথম থেকেই  এগিয়েই ছিল। সব কিছুর দেখার একটা আলাদা চোখ ছিল।

জীবন শুরুর কালে আর পাঁচটা তাঁর সমবয়সী যে ভাবে ভাবতো, তাঁর মনেও কি সেই তরঙ্গের অনুরণন দেখা দিত — আজ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। হয়তো ভাবতো কিংবা নয়। অল্প কিছুদিন কাছ থেকে দেখার সুবাদে আমার মনে হয় , ভাবনাই পার্থক্য করে দিয়েছিল তাঁকে অন্যজনের সঙ্গে।

তিনি ছিলেন অসম্ভব রকমের বাঙালি মনষ্ক।তাঁর সৃষ্টির পরতে পরতে তা অনুভব করা যেত।
জীবনের প্রথম দিন থেকে মুক্তমনা মানুষ ছিলেন। তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে তা বারেবারে ধরা পড়েছে।

জগৎসংসার ঋতুপর্ণ ঘোষকে ছবি করিয়ে হিসেবেই চিনবে; জানবে সিনেমায় তার নতুন ভাষা দেবার গল্প। কিন্তু এইটুকু পরিসরে তাঁকে আটকে রাখা সঠিক কাজ হবেনা। চিন্তা ছিল বিস্তৃত। বিজ্ঞাপনের লেখা থেকে সিনেমা পরিচালনা — সবেতেই তাঁর ব্যাপ্তি অসীম।

প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু সাউথ পয়েন্ট স্কুল থেকে। পরবর্তী কালে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এই সময় থেকেই তাঁর সিনেমার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ পেতে থাকে।

চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশের আগে তিনি ‘রেসপন্স ইন্ডিয়া’ নামের এক বিজ্ঞাপন সংস্থায় ক্রিয়েটিভ কপিরাইটার বিভাগে চাকরি করতেন। সাধারণত সেই সময় যে কোনও বিজ্ঞাপনের ভাষা সরাসরি ইংরেজি বা হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া হত। কিন্তু ১৯৮০ সাল নাগাদ তিনি বাংলা ভাষায় আলাদা ভাবে বিজ্ঞাপন তৈরি করতে থাকেন। যা বাংলার সংস্কৃতি এবং মানুষের আবেগ স্পর্শ করে। বলা বাহুল্য তাঁর লেখা ওয়ান লাইনার, টু লাইনার বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘ সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলিন – বঙ্গ জীবনের অঙ্গ ’ ইত্যাদি লেখা আজও জনপ্রিয়। ‘ফ্রুটি’-এর জন্য তাঁর তৈরি  বিজ্ঞাপন পানীয়টিকে সারা ভারতে বেস্টসেলার করে তুলেছিল। সাধারণ মধ্যবিত্ত সমাজের কাছে তাঁর লেখা সাদরে গৃহীত হত। সহজ শব্দে,  সরল বাক্যে মূল কথাকে পৌঁছে দিতেন মানুষের অন্তরে।

বিজ্ঞাপন সংস্থার চাকরি ছেড়ে ঋতুপর্ণ ছবি তৈরির কাজে হাত লাগালেন। এমন একটা সময় যখন বাংলা সিনেমা প্রায় ধুঁকছে। গুণগত মান ও মনন কোনওটারই বিশেষ ছাপ দেখা যাচ্ছিল না বাংলা সিনেমায়। সেই আবহে ঋতুপর্ণ যেন বাংলা সিনেমায় নতুন দিশা দেখালেন।

১৯৯০ সালে প্রথম তাঁর কাছে সুযোগ আসে দূরদর্শনের জন্যে ‘বন্দেমাতরম’-এর উপর একটি তথ্যচিত্র নির্মান করার। এর পর থেকেই তিনি সিনেমা পরিচালনার কাজে যুক্ত হন। ১৯৯২ সালে তাঁর তৈরি প্রথম সিনেমা ‘হীরের আংটি’ মুক্তি পায়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে এই ছবি  পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ প্রযোজনা করেছিল।

যদিও এর অনেক আগেই সমরেশ বসুর গল্প ‘মোক্তার দাদুর কেতুবধ’ নিয়ে প্রথম চিত্রনাট্য লেখেন ঋতুপর্ণ । আনন্দমেলা-য় প্রকাশিত হয়েছিল সেই ছোটদের গল্প। সেটার উপর চিত্রনাট্য লেখার মধ্য দিয়েই হাতেখড়ি । সেই গল্পের এক অন্য আধার রচনা করেছিলেন তিনি । সেখানে এক বিকিনি পরা মেয়ের ন্যারেটিভ তৈরি করেছিলেন। তার আগে অবশ্য  ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ বলে একটি ছোট ছবি তৈরি  করেন। এই যে গঙ্গাজলে লোকে কুম্ভ স্নান করে, সেটা কতটা দূষিত, সেই বিষয়টা একজন চিকিৎসকের মাধ্যমে  দেখাতে চেয়েছিলেন। তবে এই পর্যায়কে বাদ দিলে বলা যেতে পারে ‘ হীরের আংটি ‘ তাঁর প্রথম সিনেমা।

তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘উনিশে এপ্রিল’ ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায়। ১৯৯৭ সালে তাঁর পরের ছবি ‘দহন’ মুক্তি পায়। যেটি কলকাতার রাস্তায় শ্লীলতাহানি হওয়া এক নারীর জীবনের সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে বানানো।  ১৯৯৯ সালে তাঁর পরিচালনায় ‘অসুখ’ ছবিটিও জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হয়। ২০০০ সালে মুক্তি পায় তাঁর পরবর্তী ছবি ‘বাড়িওয়ালি’। ঋতুপর্ণ পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান  ‘উৎসব’ সিনেমার জন্য। এটি বাঙালি জীবনের ঐতিহ্যময় দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বানানো ব্যক্তিজীবনের গল্প।

২০০২ সালে তাঁর পরিচালনায় পরবর্তী ছবি ‘তিতলি’ মুক্তি পায়। ২০০৩ সালে আগাথা ক্রিস্টির ‘দ্য মিরর ক্র্যাকড ফ্রম সাইড টু সাইড’ অবলম্বনে ‘শুভ মহরৎ’ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ‘চোখের বালি’ সিনেমা দুটি মুক্তিলাভ করে। ২০০৪ সালে তাঁর পরিচালনার প্রথম হিন্দি ছবি ‘রেনকোট’ মুক্তি পায়। ছবিটি সে বছরের সেরা হিন্দি সিনেমার জাতীয় পুরস্কার পায়। ও হেনরির ছোটোগল্প অবলম্বনে নির্মিত ছিল ছবিটি। এ ছাড়াও অন্তরমহল, খেলা, সব চরিত্র কাল্পনিক, দোসর, দ্য লাস্ট লিয়ার, আবহমান – একের পর এক মাস্টারপিস উপহার দিয়েছেন ঋতুপর্ণ।

চিন্তা-ভাবনা-অ্যাপিয়ারেন্স এবং চিত্রনির্মাণ, কোনও দিক থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষকে বাঁধা গতে ফেলা যাবে না। তিনি সব সময় স্বতন্ত্র। স্বতন্ত্র তাঁর পরিচালনা, স্বতন্ত্র তাঁর অভিনয়। একই ভাবে সমান স্বতন্ত্র ছিল তাঁর কলমও।

প্রথম থেকেই তাঁর ছবিতে বাংলা সাহিত্যের প্রভাব দেখা গিয়েছে। তাঁর সিনেমায় রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিও ঘুরে ফিরে এসেছে।
তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি ‘রেনকোট’-এ ব্রজবুলীতে কবিতা লেখেন ঋতুপর্ণ। ঠিক যেমনটা দেখা গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘ভানুসিংহের পদাবলীতে’। শুধু কী তাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্ট চরিত্রদের নিজের মতো করে পর্দায় রূপদান করেন,  রবি ঠাকুরের ধারাকে বজায় রেখেই।

একটা বিষয় এখানে অত্যন্ত লক্ষ্যণীয়, প্রতিটি সিনেমায় তিনি তারকাদের নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু কখনও নিজের সৃষ্টির ভাবনাকে বিজাতীয় করে ফেলেননি। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক এক বাঙালি।  তাঁর সৃষ্টির পরতে পরতে তা অনুভব করা যেত।

পরিচালকের পাশাপাশি ঋতুপর্ণ যে উঁচু মানের অভিনেতা, তার প্রমাণ পাওয়া যায় কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ সিনেমায়। এই ছবিতে মুখ্য চরিত্রে ঋতুপর্ণর অভিনয় মুগ্ধ করে সিনেপ্রেমীদের।

অনেক এগিয়ে সম্পর্কের ছোট ছোট বুনটে চরিত্র তৈরি করতে পারতেন।  কোনও তুলনায় না গিয়েও বলা যায় ঋতুপর্ণ ঘোষ ছবিতে আলাদা করে মুড তৈরি করে দিতেন। মানে এ রকম বহু বার হয়েছে হয়তো পুরো ছবিটা না দেখে ছবির কোনও একটা অংশ বার বার দেখেছে দর্শক। নিজের কথা বলতে পারি, আমি ঋতুপর্ণর অনেক সিনেমা এখনও এইভাবে দেখে থাকি। এই  দেখার মধ্য দিয়ে  মনে হয়, সত্যজিতের স্কুলিং ছাড়িয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ অনেক সময় ঋত্বিকের প্যাশনকে ছবিতে এনে ভাংচুর করেছে। বাঙালির মধ্যবিত্ততা, মধ্যচিত্ততা, তার অনেক বাঁক বদল, মানব সম্পর্কের গূঢ় অতলস্পর্শী রহস্যময় ইঙ্গিত, পরিবারের একক মানে ইউনিট বদলে ভেঙেচুরে একক (অ্যালোন) মানুষের আবেগ ও আর্তনাদ বার বার ধরা পড়েছে তাঁর ছবিতে।

সব কিছুর মধ্যে ওঁর আলাদা চোখ, আলাদা খোঁজার কারণ হয়তো ঋতুপর্ণ বলেই সম্ভব ছিল! মেয়েমনকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাঁদের  ভেতরটা দেখতে পেতেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।  কোনও দিন ছবিতে ইমোশন দেব বা ক্লাইম্যাক্স তৈরি করব বলে ছবি করেননি। অথচ ছোট ছোট করে মানুষের মনের কাটাছেঁড়াগুলো অবলীলায় দেখিয়ে গিয়েছেন। যন্ত্রণা দিয়েই মেয়েমনের ভেতরটা দেখতে পেতেন ঋতুপর্ণ।

আমার ধারণা আজ নিশ্চয়ই ঋতুপর্ণ ‘মহাভারত’ বা ‘রাধাকৃষ্ণ’কে নিয়ে ছবি করার কাজে হাত দিতেন।  একটা বিষয় মানতেই হয় জনশ্রুতিকে ইতিহাস বানানোর ক্ষমতা ওঁর মধ্যে ছিল!

কি এমন তাড়াহুড়ো ছিল পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার ? আমরা কি সত্যিই হারিয়েছি তাঁকে?
তিনি কি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে চিরকাল বেঁচে থাকবেন না? তিনি কি আজীবন সিনেমার সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকবেন না? এই প্রশ্নগুলির উত্তর একটাই —-

ঋতুপর্ণ ঘোষ  নেই, কিন্তু, তাঁর সৃষ্টি আজও  ‘আবহমান’।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here