ভাস্কর ঘোষাল  :  প্রশাসন  এবং আদালতের মধ্যেকার সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন একটা দড়ি টানাটানি থাকবে। তা ভাল না খারাপ সেই তর্কে না গিয়েও বলতে পারি খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। কোনও রাষ্ট্রের প্রতি অঙ্গ নিজেদের মধ্যে আদানপ্রদান, নজরদারি এবং সংশোধনের মধ্য দিয়ে ভারসাম্য বজায় রেখে চলবে। সকলের দৃষ্টি যেন থাকে সকলের প্রতি। কোনও একটি অঙ্গ অন্য একটি অঙ্গের তুলনায় যেনও বেশি শক্তিশালী না হয়ে যায়। এই আদর্শ অবস্থা আমাদের কাছে সকল সময় কাম্য। কিন্তু বাস্তবে অনেক সময়ই ‘ আইডিয়াল ‘ অবস্থা থেকে তা দূরে সরে যায়। ভারসাম্য নষ্ট হয়, তখন বিপত্তি দেখা দেয়।

অনেক সময়ই আমাদের সাদা দৃষ্টিতে ধরা পড়ে বিচার বিভাগের ‘ অতিসক্রিয়তা ‘। যে কাজ যার করা উচিৎ সময় মতন সে সেই কাজ না করলেই বাঁধে গোল। যে কাজ প্রশাসনের বা আইনসভার করার কথা, সেই কাজে বিচারবিভাগ হস্তক্ষেপ করছে, এই অভিযোগ এ দেশে বহুচর্চিত।

কিছুদিন আগেও রাষ্ট্রদ্রোহ আইন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আইন এবং বিচারবিভাগের মন্ত্রীর মন্তব্যে সমালোচনার সুর শোনা গিয়েছে। আমার এখানেই প্রশ্ন আদৌ বিচারপতিরা কি হঠাৎ হঠাৎ অতিসক্রিয় হয়ে ওঠেন না চারিপাশের চাপে একজন বিচারপতি অতি সক্রিয় হতে বাধ্য হন। আমি জানি এ এমন এক প্রশ্ন যা সর্বসম্মতিক্রমে উত্তর খুঁজে পাওয়া আমাদের মতন গণতান্ত্রিক দেশে প্রায় অসাধ্য।

সকলে নিজের নিজের কাজ করলে কোনও সমস্যাই থাকেনা। প্রশাসন এবং আইনসভা নিজের নিজের কাজ ঠিকমতো ভাবে করলে বিচারবিভাগকে এত বেশি ‘হস্তক্ষেপ’ করতে হত না।

স্বাধীনতার বয়স পঁচাত্তর। এতদিন ধরে
রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের মতো স্পষ্টত গণতন্ত্র-বিরোধী আইন বাতিল করার সৎ উদ্যোগ কোনও সরকার নিতে পারেনি। একই পথের পথিক হয়েছে বর্তমান সরকারও। দেশের এবং রাজ্যের সর্ব স্তরে প্রশাসন কেন মানবাধিকারের, এমনকি সংবিধান-স্বীকৃত মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় যথেষ্ট তৎপর হয় না, তা দেখে অবাক লাগে। এমনকি দেশের আইনগুলি পর্যন্ত মেনে চলার দায় স্বীকার করে না— দেখে বিপর্যস্ত লাগে। এ দেশে বিচারবিভাগকে যদি অতিসক্রিয় হতে হয়, সেটা অন্য বিভাগগুলির চূড়ান্ত অকর্মণ্যতার কারণেই।

পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং যা ঘটছে তাকে ‘পুরনো কথা’ বলা যায় না। আদালত না বললে প্রশাসনের একাংশের কর্তারা কোনও কাজই করেন না। আইন না মানাই প্রায় একটা রেওয়াজে পরিণত হয়ে উঠেছে। সামান্য বিষয় হলেও মানুষকে পৌঁছাতে হবে আদালতের দুয়ারে। তারপর ঘুম ভাঙবে কর্তাব্যাক্তিদের। এক অদ্ভূত পরিস্থিতি। চোখ খোলা রাখলে দেখতে পাওয়া যায় যে, প্রতিদিন আইন মানা নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রশাসনের যেনও লুকোচুরি খেলা চলছে।

সম্প্রতি শিক্ষা দফতর সংক্রান্ত একশো তেত্রিশ কোটি অনিয়মের কথা শোনা যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন আদালত প্রশাসনকে তিরস্কার করতে বাধ্য হচ্ছে। এই ঘটনায় লজ্জিত না হয়ে নানা উপায়ে তা প্রতিহত করার চেষ্টা চলছে। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের মিল হয়না , তাই বলে এত বৈপরীত্যও কখনও দেখা যায়না।

আদালতের কড়া নির্দেশের পরে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী সিবিআইয়ের সামনে হাজির হলেন। বর্তমান শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারী মহাশয় সম্বন্ধে খোঁজ করেও জানা যাচ্ছিল না যে, তিনি ঠিক কোথায় আছেন। কখনও ট্রেন আবার কখনও প্লেন —- যাই হোক শেষমেষ আদালতের কড়া শাসনের দরুন তিনিও সিবিআই দরজা পর্যন্ত পৌঁছলেন। মধ্যরাতে আদালত বসল। পরতে পরতে উত্তেজনা। প্রশাসনের মুখ পুড়ল। আপামর বাংলার মানুষের কাছে মাথা নীচু হল।

শিক্ষক নিয়োগকে ঘিরে শত শত অভিযোগ। আদালতের একের পর এক কঠোর নির্দেশ ও মন্তব্যের পরে রাজ্য সরকারের চেতনার উন্মেষ ঘটা প্রয়োজন। ভুল স্বীকার করার মধ্য দিয়ে পরাজয় ঘটেনা। বরং আগামী দিনে সঠিক ভাবে চলতে সাহায্য করে। যে ভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সিবিআই তদন্তের দাবি উঠছে, তাতে বোঝা যায়, নাগরিকের আজ সরকারের উপর আস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যবাসী তাঁর নিজের পুলিশ-প্রশাসনকে কোন চোখে দেখছে। এখান থেকে উপলব্ধি করা যায় দুর্নীতিতে ও আইনলঙ্ঘনে নিমজ্জিত এই বিশ্বাস, সমাজের কোণে কোণে কতখানি ছড়িয়ে পড়েছে।

আদালত আজ প্রবল সক্রিয়। তীব্র থেকে তীব্রতর প্রতিক্রিয়ায় বিদ্ধ করছে প্রশাসনকে। কিন্তু তাতে লাভ নেই। নিজের কোথায় গলদ তা সরকারকেই বুঝতে হবে। এখানে আদালত শুধুনাত্র দোষ-ত্রুটি দেখাতে পারে কিন্তু শুধরে দিতে পারেনা। সেই কাজ প্রশাসনকেই করতে হবে।

শুধু তিরস্কারের মধ্যে দিয়ে শুদ্ধির আশা নেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here