সম্পাদকের কলমে
অণুসাহিত্য
সিদ্ধার্থ সিংহ
বলছি, বহু বছর আগের কথা। তখন সদ্য একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছি। তার সঙ্গে আলাপের প্রথম দিন থেকে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার দিন পর্যন্ত তাকে নিয়ে লিখেছি মোট পঁচাত্তরটি কবিতা।
পরে সেটি ‘মণিপর্ব’ নামে বই হয়ে বেরোয়। যে দিন মণির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল, ভেবেছিলাম, আত্মহত্যা করব। তেরো দিন অ্যাসাইলামে ছিলাম। ডাক্তারেরা আমাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতেন।
যে দিন উঠে বসলাম, সে দিনই নাকি কলম তুলে নিয়েছিলাম আমি। অ্যাসাইলামের খাটে বসেই একটানা নন স্টপ ঘোরের মধ্যে লিখে গিয়েছিলাম উন্মাদের মতো।
যখন ঘোর কাটল, দেখলাম, কুট্টি কুট্টি একশো সাঁইতিরিশটি গল্প লিখে ফেলেছি। যার একটার সঙ্গে অন্যটার কোনও মিল নেই।
সেগুলো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বেরোতেও লাগল। কোথাও দুটি, কোথাও তিনটি, কোথাও হাফ ডজন তো কোথাও আবার এক ডজন।
সেখান থেকে একশো কুড়িটা গল্প বাছাই করে কলেজ স্ট্রিটের একুশ শতক প্রকাশনী থেকে অবশেষে প্রকাশিত হল আমার একমাত্র অণুগল্পের বই— দশ ডজন অণুগল্প।
ওই বইয়ের বিক্রির বহর দেখে নান্দনিক প্রকাশনীর কর্ণধার সঞ্জয়দা একদিন আমাকে অনুরোধ করলেন, বিভিন্ন লেখকের ওই ধরনের বেশ কিছু গল্প নিয়ে একটি সংকলন করে দেওয়ার জন্য।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর আমি মিলে ওই প্রকাশনীর জন্য যৌথ সম্পাদনায় তৈরি করে দিলাম একটি অণুগল্পের সংকলন— ‘শত লেখকের শত অণুগল্প’। মানে একশো জন লেখকের একশোটা অণুগল্প। সেটাও চূড়ান্ত সাড়া ফেলেছিল।
আমার ‘দশ ডজন অণুগল্প’র সাফল্য দেখে যেমন অনেক তরুণ লেখক তখন ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অণুগল্প লেখার জন্য। ঠিক তেমনি, পাঠক মহলে ওই সংকলনটির ব্যাপক চাহিদা দেখে তার পরেই ছোট-বড় প্রচুর প্রকাশক শুরু করে দেন একের পর এক অণুগল্পের বই এবং সংকলন করা।
তখন বিশাল মোটা মোটা দেড়-দু’হাজার পাতার এক-একটি সংখ্যা বের করে বাংলা সাহিত্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল তেহাই পত্রিকা।
সেই পত্রিকার সম্পাদক আমার বাড়িতে একদিন এসেছিলেন, উত্তম কুমারকে নিয়ে লেখা আমার একটি গদ্য নেওয়ার জন্য।
এসে আমার টেবিলের এক কোণে ওয়েস্ট পেপার বাক্সে আমার দলা পাকিয়ে ফেলে দেওয়া অজস্র কাগজের গোল্লা দেখে বলেছিলেন, কত দিন পরিষ্কার করোনি ওটা?
আমি বলেছিলাম, আসলে আজকে একটা কবিতা লিখবো বলে বসেছিলাম। কিন্তু এক-দু’লাইন লেখার পরেই মনে হচ্ছিল লেখাটা হয়নি। তাই ফেলে দিয়েছি। ফেলতে ফেলতে এই অবস্থা হয়েছে।
সেই গোল্লা পাকানো কাগজগুলো ও পলিপ্যাকে করে নিয়ে গিয়েছিল। দু’দিন পরে ফোন করে জানিয়েছিল, আমি এটা বই করতে চাই।
আমি বলেছিলাম, ওগুলো দিয়ে কীভাবে বই হবে?
ও বলেছিল, হবে হবে, পকেট বই হবে।
ক’দিন পরেই কলকাতা প্রেস ক্লাবে মহা ধুমধাম করে ও প্রকাশ করল সেই বই। মোড়ক উন্মোচন করলেন ক্রীড়া সাংবাদিকতার রাজপুত্র, আনন্দবাজার পত্রিকার ক্রীড়া সম্পাদক গৌতম ভট্টাচার্য। বইটির চেহারা দেখে আমি চমকিত। অসম্ভব সুন্দর একটি বই।
মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই নিঃশেষিত হয়ে গেল এগারোশো কপি। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল বইটির কথা। বইয়ের জন্য প্রকাশকের বাড়ি পর্যন্ত হানা দিতে লাগল অনেকেই।
ছাপা হল দ্বিতীয় মুদ্রণ। সাড়ে পাঁচ হাজার কপি। সেটাও শেষ হয়ে গেল ছ’মাসের মধ্যেই। প্রায় মাস চারেক আউট অফ প্রিন্ট থাকার পরে অবশেষে বেরোল তৃতীয় সংস্করণ। না, তেহাই প্রকাশনী থেকে নয়, এ বার গার্গী প্রকাশনী থেকে।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এ বইটি নাকি প্রকাশকের মেয়ের খুব প্রিয় একটি বই। তার থেকেও বড় কথা, শুধু প্রকাশকের মেয়েই নয়, ওই প্রকাশকের দিদির মেয়ে নাকি এই বইটিকে কিছুতেই হাতছাড়া করে না। প্রতিদিন রাতে মাথার কাছে নিয়ে ঘুমোয়।
এটা জানতে পেরে আমি তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। দেখে তো আমি তাজ্জব। একরত্তি একটি মেয়ে, সেভেন না এইটে পড়ে! তার এই কাণ্ড দেখেই নাকি ওই প্রকাশিকা এই বইটি করতে এতটা আগ্রহী হয়েছেন।
এ সব বহু দিন আগের কথা। তার পরেই বাংলা সাহিত্যে আছড়ে পড়ে অণুসাহিত্যের ঝড়। সেই ঝড় আরও বেগ পায় ওয়েব ম্যাগাজিনগুলো আসার পরে।
কারণ ওয়েব ম্যাগাজিন বা ফেসবুকের পাঠকেরা বেশি বড় লেখা পড়তে চান না। সে যত ভাল লেখাই হোক না কেন। তাঁরা শুধু ছবি লাইক করেন। আর ছোট্ট ছোট্ট লেখা হলে পড়েন।
ছোট লেখা যে পড়েন, সেটা আর সকলের মতো আমিও খুব টের পাই। পাঠকদের কমেন্টস দেখে।
যত ওয়েব ম্যাগাজিন বেরোবে এবং ওয়েবজিনগুলোর রমরমা বাড়বে, ততই আরও অনেক বেশি করে জায়গা পাবে অণুসাহিত্য।
আর ওয়েবে জায়গা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অণুসাহিত্য যে প্রিন্ট মিডিয়াও আস্তে আস্তে দখল করে নিচ্ছে, নিজের একটা স্বতন্ত্র জায়গা করে নিচ্ছে, তার প্রমাণ কিন্তু আমরা ইতিমধ্যেই বেশ টের পাচ্ছি।
বুঝতে পারছি অণুসাহিত্যের ঝড় আরও ব্যাপক ভাবে শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, গোটা বিশ্ব সাহিত্যে আছড়ে পড়তে চলেছে। যত পড়বে ততই মঙ্গল।