বেঙ্গল ওয়াচ নিউজ ডেস্ক:স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কার্যত সেনার হাতেই ক্ষমতা পাকিস্তানের। তাদের কথাতেই উঠবস। পাকিস্তানের থেকে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই। ১৯৭১-এ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বারে বারে সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে বাংলাদেশে। সেখানকার গণতন্ত্র কোনওদিনই মসৃন নয়।

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে (পূর্ব-পশ্চিম মিলিয়ে) পূর্ব পাকিস্তানের আসনগুলিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় মুজিবর রহমানের আওয়ামি লিগ। ১৬২ টি আসনের মধ্যে ১৬০ টি আসন দখল করে তারা। অন্যদিকে জুলফিকর আলি ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি পূর্ব পাকিস্তানের ১৩৮ টি আসনের মধ্যে ৮১ টি আসনে জয়ী হয়।

সেই সময় পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ছিল ক্ষমতা। তিনি আওয়ামি লিগ তথা মুজিবর রহমানের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে অস্বীকার করেন। যা নিয়ে অস্থিরতা জন্ম নেয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। আগে থেকেই সেখানে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছি। তার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়ায় সেই অস্থিরতা চরম আকার নেয়।

১৯৭১ সালের সাত মার্চ মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রামের আহ্বান জানান। যার জেরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বিক্ষোভ দমন করতে কুখ্যাত অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। যার জেরে সেই সময় বাংলাদেশ জুড়ে চলে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ ও অবৈধ গ্রেফতার এবং অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা।

এই পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করেন। যার জেরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়। ভারত সেই সময় সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। মুক্তিবাহিনী গঠন করতে সবরকমের সাহায্য দেয়। মুক্তি বাহিনীতে সাধারণ মানুষ যোগ দেয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়।

স্বাধীনতা লাভের পরে মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশ হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পরের বছরগুলিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা সেনাদের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগ সেনাবাহিনীতে বিভাজন তৈরি হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে প্রথম অভ্যুত্থান হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট রাতে। কয়েকজন তরুণ সেনা আধিকারিক প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান, স্ত্রী, তিন ছেলে পরিবারের অন্য সদস্য-সহ ১৮ জনকে গুলি করে হত্যা করে। সেই সময় শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা ছিলেন বিদেশে।

মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ এবং রাজনীতিবিদ খন্দকার মোস্তাক আহমেদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সেনা অভ্যুত্থান হয়। নতুন শাসন ব্যবস্থায় খন্দকার মোস্তাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হন। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নতুন সেনাপ্রধান হন।

তবে নতুন শাসকরা বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। ১৯৭৫-এর তেসরা নভেম্বর মুজিবের সমর্থক বলে পরিচিত ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ আরেকটি অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন এবং নিজেকে নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন।

চারদিনের মধ্যে ফের এক অভ্যুত্থান। এটা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের বামপন্থী রাজনীতিবিদদের সহযোগিতায় হয়। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের মৃত্যু হয়। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হন।

জিয়াউর রহমানের বিএনপি অর্থাৎ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পার্টি ১৯৭৮-এর সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করেন। কিন্তু বছর তিনেকের মধ্যে ১৯৮১ সালে মেজর জেনারেল মঞ্জুরের নেতৃত্বে একটি সেনা ইউনিট জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে দেয়। বিদ্রোহীরা রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা সেনাদের সমর্থনের অভিযোগ তোলে। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা অধিকাংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফিরে আসে।

১৯৮২-এর ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেন মহঃ এরশাদ রক্তপাতহীন অভ্যুর্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি সংবিধান স্থগিত করে সামরিক আইন জারি করেন। তিনি রাষ্ট্রপতি পদে জিয়াউর রহমানের স্থলাভিষিক্ত হওয়া আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে দেন।

১৯৮৬ সালে এরশাদ জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠা করেন। এবং ১৯৮২ সালের অভ্যুর্থানের পরে বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের অনুমতি দেন। নির্বাচনে এরশাদের দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশের রাষ্ট্রপতি পদে ছিলেন এরশাদ। গণতন্ত্রপন্থীদের বিক্ষোভের কারণে তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরে আসলেও সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ চালিয়ে গিয়েছে বিভিন্ন সময়ে।

২০০৭-এ ফের সেনা অভ্যুত্থান
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামাত সরকার। তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে ফের একবার বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। নতুন নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বাছাই নিয়ে আওয়ামি লিগ ও বিএনপির মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

২০০৭-এর ১১ জানুয়ারি সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট মইনুদ্দিন আহমেদ সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। তিনি সামরিক-তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন। তিনি অর্থনীতিবিদ ফখরুদ্দিন আহমেদকে সরকারের প্রধান নিযুক্ত করেন। সেই সময় রাষ্ট্রপতি পদে ছিলেন ইয়াজউদ্দিন আহমেদ।

২০০৮-এর ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। সামরিক শাসনের আবসান হয়। তারপর ২০১৪, ২০১৯, ২০২৪-এর নির্বাচনে জয়ী হন শেখ হাসিনা। তবে তাঁর বিরুদ্ধে জোর করে নির্বাচনে জয়ের অভিযোগ তোলে বিরোধীরা।

শেষ পর্যন্ত ২০২৪-এর ৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *